দ্বিমাত্রিক উৎস ও স্থপতি মাজহারুল ইসলাম

লেখক: মুস্তফা খালীদ পলাশ

বৃত্ত সে যত বড়ই হোক না কেন, তার প্রসারণ বা সংকোচন কিন্তু বিন্দু কে বাদ দিয়ে নয়। কিংবা বিন্দু থেকে উৎসারিত যে বৃত্ত সেখানে বিন্দুর অস্তিত্ব অদৃশ্য হলেও তা ধ্রুব সত্যের মত উপস্থিত। এই অস্তিত্বহীনতা জানান দেয় এক শক্তিশালী উৎসের। বিষয়টিকে দু’ভাবেই দেখা যেতে পারে, এক : মহাজাগতিকতার মাঝে, দুই : বৈষয়িক পার্থিবতার ক্ষেত্রে। লেখাটি একটু ভিন্নভাবে শুরু হলেও এর উপাত্ত বিশেষ স্থাপত্য ও একজন বিশেষ স্থপতির, যিনি আমাদের দেশের সমকালীন স্থাপত্যের জনক হিসেবে বিবেচিত।

কেন মাজহারুল ইসলামকে সমকালীন বাংলাদেশের স্থাপত্যের আচার্য বলছি আমরা? শুধু কি তিনি অগ্রণী বা প্রথম আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন তাই? না কি তাঁর সমসাময়িক কোন বাঙালী স্থপতি ছিলনা তাই? না কি তিনি সবচেয়ে বয়জ্যেষ্ঠ স্থপতি তাই? এর কোনোটিই নয়। তবে তিনি কেন স্থাপত্যাচার্য?

এ বিষয়ে অনেক দার্শনিক মতবাদ দেয়া যেতে পারে বা বিভিন্ন বিদগ্ধজন ইতোমধ্যেই তা প্রকাশ করেছেন। তাহলে অপেক্ষাকৃত নতুন কি বিষয়ের অবতারণা করা যেতে পারে? তাঁর স্থাপত্যের ’দ্বিমাত্রিক উৎস’ নিয়ে সরাসরি আলোচনা বা লেখা থাকলেও থাকতে পারে।

লেখার শুরুতে যে আভাস দেয়া হয়েছে আবার সেখানেই ফেরত যেতে চাই। স্থাপত্যের উৎস মস্তিষ্কে বা মননে হলেও এর বহিঃপ্রকাশ দ্বিমাত্রিকতার ধাপ বেয়ে ত্রিমাত্রিক অবয়বে। স্থাপত্যের এই ’স্থাপত্য’ হয়ে ওঠা মনস্তাত্বিক, জ্যামিতিক ও ব্যবহারিক স্তর পেরিয়ে, যা কিনা প্রতিটি স্থপতির বা স্থাপত্যের জন্য এক অপরিহার্য প্রক্রিয়া। মাজহারুল ইসলামও স্থপতি হিসেবে সেই সব স্তরের মধ্যে দিয়েই রচনা করেছেন তাঁর স্থাপত্য।

পরিসরকে জড়িয়ে ধরে যে খোলস ত্রিমাত্রিক অবয়বে আর্বিভূত হয় তার শিল্পমান বহুলাংশে নির্ভর করে মস্তিষ্ক প্রণোদিত দ্বিমাত্রিক বিন্যাস বা two dimensional composition-এর উপড়। স্থপতি মাজহারুল ইসলামের স্থাপত্য কর্ম সর্বৈব সামাজিক, নন্দনতাত্বিকভাবে গৃহীত এবং সময় ও পরিসর অতিক্রান্ত। কিন্তু এই ত্রিমাত্রিক আকার ভ্রুণের মত এক সময় উৎসারিত হয় স্থপতির মস্তিষ্ক-গর্ভে এবং তা স্থপতির হাত বেয়ে প্রথমে প্রকাশিত হয় এক দ্বিমাত্রিক চিত্রে।

এক্ষেত্রে স্থপতি অতি তাড়িত হন ’শিল্প’ দ্বারা আবার কেউ কেউ হয়ে ওঠেন আতি উপযোগিতাবাদী। স্থপতি মাজহারুল ইসলাম প্রথমত একজন স্নাতক এরপর পূরকৌশলে স্নাতক এবং পরবর্তীতে স্থাপত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষা নিয়েছেন। ভাবা যায় কিভাবে একজন পূরকৌশলী পুরদস্তুর স্থপতি হয়ে ওঠেন? বিষয়টি ভাববার এবং এর কার্যকারন খুঁজে পাওয়া সত্যিই কঠিন। একজন স্থপতি যদি পুরকৌশলের মাঠ পেরিয়ে স্থাপত্যে নিজেকে নিমগ্ন করেন তখন আমরা দেখি সেই স্থপতির শক্ত হয়ে যাওয়া হাত আর অসৃজনশীল মনন। খুব কম মানুষই আছেন যারা এই পূর্ব অর্জিত কাঠিন্য-খোলস ভেংগে বের হয়ে আসতে পারেন।

\"\"

স্থাপত্যাচার্য মাজহারুল ইসলাম সেই ক্ষণ-জন্মাদের একজন যিনি তাঁর পূর্বাধৃত জ্ঞান কে তাঁর স্থাপত্যে স্থান দিয়েছেন ধনাত্বক ভঙ্গিমায় নমনীয়তার সাথে।

এবার সরাসরি বিষয় ভিত্তিক উপস্থাপনায় যেতে চাই। প্রথমেই বলা হয়েছে স্থাপত্য তার চুড়ান্ত রূপ পায় তার ত্রিমাত্রিক অবয়বে কিন্তু সেই ত্রিমাত্রিকতার উত্থান ”দ্বিমাত্রিক-চিত্রকল্পের” মাঝ দিয়ে। এ লেখায় স্থপতি মাজহারুল ইসলাম-এর সেই দ্বিমাত্রিক চিত্রকল্পের বিশ্লেষণ তাঁর ’চারুকলা’ সম্বন্ধীয় মননের এবং এর সাথে তাঁর সৃষ্ট চুড়ান্ত স্থাপত্যের মিথোজীবিত্ব (symbiosis)এর অনুসন্ধানের চেষ্টা করা হয়েছে যা কিনা একজন স্থপতি হিসেবে আমাদের ভেবে দেখার প্রয়োজন নিজেদের স্বার্থেই।

এক্ষেত্রে স্থপতি মাজহারুল ইসলামকৃত তাঁর বিশেষ কিছু প্রকল্পের সহায়তা নেয়া হয়েছে যেগুলো তাঁর সর্বাধিক সমাদৃত স্থাপত্যকর্ম হিসেবে বিবেচিত।

\"\"

এই লেখার বিষয় নির্বাচন নিয়ে একটু বলে নিতে চাই। পেছনে ফিরে গিয়ে যে কোন বিষয়ের উৎপত্তি বা উৎসের খোঁজ নেয়া এক সাধারণ প্রথা।

এই লেখাও সেরকমই এক প্রচেষ্টা। স্থপতি মাজহারুল ইসলাম-এর স্থাপত্য সৃষ্টির পূর্বপর্যায় অনুসন্ধান এর মাধ্যমে তাঁর স্থাপত্যের মহিমান্বিত হয়ে ওঠার পটভূমির কিছুটা ধারণা তৈরী করা যায় কিনা পরবর্তী অংশে তারই এক ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা করা হয়েছে।

আবারও বলতে হচ্ছে এই প্রচেষ্টা তাঁর ’দ্বিমাত্রিক’ সূচনাকে নিয়ে করা হয়েছে। এই দ্বিমাত্রিক রূপকল্প আমার নিজস্ব স্থাপত্য চর্চায়ও এক বিশেষ স্থান নিয়ে আছে।

কারণ আমার স্থাপত্য দর্শন সার্বজনীন/দ্বিমাত্রিক জ্যামিতিকতা এক শৈল্পীক অবতারণা যা কিনা শেষ পর্যন্ত প্রতিটি স্থাপত্যের এক নিহিত অংশ হয়ে ত্রিমাত্রিকতায় প্রকাশিত হতে থাকে। চকিতে এই সুপ্ত দ্বিমাত্রিক রূপকল্প বা graphics বোঝা কঠিন যা কিনা শুধুমাত্র সুক্ষ ও ঘনিষ্টতা দিয়েই ঠাহর করা যায়।

এতকিছু বলার উদ্দেশ্য একটিই তা হলো একজন কালোত্তীর্ণ স্থপতি হতে হলে তাকে চিত্রশিল্পের গণ্ডি পেড়িয়ে এমন এক অবস্থানে দাঁড়াতে হয় যেখানে এসে সেই চিত্রশিল্প পরিণতি লাভ করে পরিসরের সাথে যুগলবন্দি রচনা করে।

স্থাপত্যের উৎস খুঁজে পেতে প্রাথমিকভাবে স্থপতি খুঁজে নিয়েছেন একটি শুষ্ক পরিখাকে। পেয়েছেন আরো প্রাকৃতিক উৎপাদন। এরপর সেই বৃত্তাকার পরিখার কেন্দ্রকে স্থানান্তর করে রচনা করেছেন তাঁর নিজের ’দ্বিমাত্রিক’ ’চিত্রকল্প’ সহজ সাবলীল রেখায়, বিমূর্ত করেছেন প্রাকৃতিক ক্যানভাসকে। (চিত্রমালা-১ক)।

এখানে স্থপতি অবশ্যম্ভাবীভাবে নিজের এবং উপস্থিত প্রকৃতির মাঝে গড়ে তুলেছেন এক সাঙ্গীতিক ব্যঞ্জনা। তাঁর এই দ্বিমাত্রিক বিন্যাস পরবর্তীতে ত্রিমাত্রিক আকার ধারণ করলেও বিলীন হয়েছে প্রকৃতির কাছে পরম এক সরল আধুনিকতার মধ্যে দিয়ে। ভাবা যায় না স্থপতি মাজহারুল ইসলামের মনন সময়ের সাথে এক অসম লয় সৃষ্টি করে কতটাই না কালোত্তীর্ণ স্থাপত্য রচনা করেছে।

আমরা কজনাই বা বুঝি কত গভীর ভাবে এই নান্দনিকতা, যার সূত্রপাত মনন থেকে উৎসারিত হয়ে তৈরি করেছে এক শৈল্পিক ’চারুকলা’, যা প্রতিসমতার মাঝে অবস্থান করেও এক অপ্রতিসম দ্বিমাত্রিক চিত্রকল্পে (graphics) আবির্ভূত হয়েছে। আকল্পে চারুকলা ভবন যেমন প্রকৃতি থেকে উদ্ভূত, তেমনই ত্রিমাত্রিক গঠনে স্থপতি তার সারল্য দিয়ে তাঁর সৃষ্টিকে আমাদের কাছে স্তম্ভিত করেছেন প্রকৃতির মাঝে বিলীন করে। এক কথায় ’চারুকলা’ ভবনের অশেষতাই প্রমাণ করে যে স্থপতির সেই স্থাপত্যই সার্থক স্থাপত্য, যা কিনা স্থপতির মনন, তার দ্বিমাত্রিক প্রকাশ ও পরিশেষে ত্রিমাত্রিকতার এক অনবদ্য ঐকতান তৈরি করতে পারে। (চিত্রমালা-১খ)।

স্থপতি মাজহারুল ইসলাম শুধু যে ’চারুকলা’ ভবনেই এমনটি করেছেন তা নয়। তাঁর প্রতিটি স্থাপত্য কর্ম রচনায়ই তিনি হয়তো একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছেন। তাঁর এই দ্বিমাত্রিক রূপকল্পের গুরুত্ব খুঁজে পাওয়া যায় তাঁর সকল স্থাপত্য কর্মের মাঝে, এক পরিণত চারুশিল্পীর পক্ষেই যা করা সম্ভব। এ লেখার পরিমিত পরিসরগত সীমাবদ্ধতার জন্য শুধু দু-একটি স্থাপত্য কর্মের দ্বিমাত্রিক চারুকল্প হয়ে ওঠার উদাহরণ দেয়া হলো। উদাহরণ গুলোর দ্বিমাত্রিক উৎস খুঁজতে গেলে দেখা যাবে কখনো তিনি কৌণিক রেখা দিয়ে তৈরি করেছেন অসম্ভব বেগবান তির্যকতার (চিত্রমালা-২) বা কখনো সপ্রতিভ চতুষ্কোণিক আকার দিয়ে জানান দিয়েছেন স্থাপত্যকর্মের বিশালতার (চিত্রমালা-৩)।

পরিশেষে এটুকু নিঃসন্দেহে বলা যায় , মাজহারুল ইসলামের একজন মহান স্থপতি হয়ে ওঠার পেছনে বহুবিধ কারণ বিদ্যমান, যার মাঝে তাঁর দ্বিমাত্রিক বিন্যাস বা চিত্রকল্প অন্যতম। স্থাপত্য আলোচনায় সাধারণত এই দ্বিমাত্রিক জ্যামিতিক চিত্রকল্পের বিষয়টি খুব একটা উঠে আসেনা বলেই এই লেখায় স্থপতি মাজহারুল ইসলাম এর এই বিশেষ স্থাপত্য উপজীব্য নিয়ে স্বল্প পরিসরে এক ভিন্ন প্রণোদনা তৈরির চেষ্টা করা হয়েছে।

দ্রস্টব্য:
লেখাটি আবুল হাসনাত সম্পাদিত ও বেঙ্গল পাবলিকেসন্স লিঃ কর্তৃক প্রকাশিত ‘স্থপতি মাজহারুল ইসমাল’ গ্রন্থে পূর্ব প্রকাশিত। সাল ২০১৫।

Leave a Comment